শবে কদর অর্থ হলো ভাগ্য রজনী যা মর্যাদাপূর্ন রাত।আরবিতে একে লাইলাতুল কদর বলা হয়। শবে কদরের রাত হচ্ছে সেই রাত যা হাজার মাসের চেয়ে উত্তম রাত ।পবিত্র মহাগ্রন্থ আল কুরআন নাযিলের মাস হচ্ছে রমজান মাস, আর রাত হচ্ছে শবে কদরের রাত অর্থাৎ লাইলাতুল কদর।
এই রাতেই হেরা পর্বতের গুহায় মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে জিব্রাইল আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মাধ্যমে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর প্রতি পবিত্র কোরআন মাজীদ অবতীনের সূচনা হয়।
মহান আল্লাহ বলেন,” রমজান মাস! যে মাসে পবিত্র কোরআন নাযিল হয়েছে মানবের দিশারী রূপে ও হেদায়েতের সুস্পষ্ট নিদর্শন হিসেবে।”( সুরা বাকারা আয়াত ১৮৫)
শবে কদরের রাত
শবে কদরের রাত সম্পর্কে মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,” তোমরা রমজানের শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলোতে শবে কদর সন্ধান করো।”( মুসলিম শরীফ)।
আরবিতে দিনের আগে রাত গণনা শুরু হয়। এ রাত গুলো হলো ২১,২৩,২৫,২৭,ও২৯।অর্থাৎ.২০,২২,২৪,২৬ও২৮ রমজান এর দিবাগত রাত সমূহ।
নবীজি সাঃ বলেন, “যে ব্যক্তি শবে কদরের রাতে ঈমানের সঙ্গে সওয়াবের নিয়তে ইবাদত করবে, তার অতীতের সকল গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।”( বুখারী শরীফ)।
পবিত্র কুরআনের সূরা কদরে “লাইলাতুল কদর” শব্দটি তিন তিনবার করে রয়েছে; নয় কে তিন দিয়ে গুণ করলে ২৭ হয় তাই ২৭ রমজানের রাতে শবে কদরের সম্ভাবনা বেশি। (তাফসিরে মাজহারী)।
হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু নবীজিকে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি যদি শবে কদর সম্পর্কে জানতে পারি, তাহলে ওই রাতে আমি আল্লাহর কাছে কি দোয়া করব? নবীজি বলেন, তুমি বলবে, “আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন, তুহিব্বুল আফওয়া;ফাফু আন্নি।”
(হে আল্লাহ! আপনি ক্ষমাশীল, ক্ষমা করা পছন্দ করেন, সুতরাং আমাকে ক্ষমা করে দিন।)( ইবনে মাজাহ)।
শবে কদরের রাতে সূর্যাস্তের পর মহান আল্লাহ প্রথম আসমানে নেমে এসে,বান্দাদের আহ্বান করেন, “কে আছো অসুস্থ আমার কাছে চাও আমি সেফা দান করব, কে আছো অভাবগ্রস্ত আমার কাছে চাও আমি প্রাচুর্য দান করব,কে আছ বিপদগ্রস্ত আমার কাছে চাও আমি বিপদমুক্ত করে দেব।”
এই শান্তির ধারা চলতে থাকে ঊষা বা ফজর পর্যন্ত।
শবে কদরের রাত হচ্ছে কুরআন নাযিলের রাত। এ কারণে মহান আল্লাহ এ রাতের মর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছেন। এ রাতেই আল্লাহ তাআলা উম্মতে মুহাম্মদীকে হাজার মাসের ইবাদত বন্দেগী ও আমলের সমান সওয়াব দান করেন।কুরআন মাজীদের অন্য স্থানে এ রাত টিকে বরকতময় রাত উল্লেখ করা হয়েছে।
শবে কদরের মর্যাদা
শবে কদরের রাতে মহান আল্লাহর ওইসব বান্দারাই সবচেয়ে বেশি সম্মানিত ও মর্যাদার অধিকারী হবেন, যাদের সাথে কুরআন মাজীদের সম্পর্ক বেশি রয়েছে। যারা কুরআন সুন্নাহর আলোকে জীবনকে সাজাবেন ও পরিচালিত করবেন, তারাই হবেন সফলকাম ও আল্লাহর প্রিয় বান্দা।
শবে কদরের মর্যাদা এত বেশি যে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ রাতটি পাওয়ার জন্য রমজানের শেষ দশকে আজীবনই ইতেকাফ করেছেন।রমজানের শেষ দশকে যে কোন বিজোড় রাতে লাইলাতুল কদর তালাশ করা যায়।অর্থা.২১,২৩,২৫,২৭,২৯ রমজানের দিবাগত রাতগুলো।
তবে অনেক আলেমদের গবেষণায় ২৬ রমজান দিবাগত রাত অর্থাৎ ২৭ তারিখ পবিত্র শবে কদরের অন্যতম সম্ভাব্য রাত।মর্যাদার এ রাত পেলে মুমিন বান্দারা আল্লাহর কাছে কি প্রার্থনা করবেন? এর উত্তরে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, মুমিন বান্দারা আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইবেন।
উম্মতে মোহাম্মদীর উদ্দেশ্যে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আমি কদরের রাতের সন্ধানে রমজানের প্রথম ১০ দিন ইতেকাফ করলাম। এরপর এতেকাফ করলাম মধ্যবর্তী ১০ দিন। তারপর আমার প্রতি ওহী নাযিল করে জানানো হলো যে, তা শেষ দশ দিনে রয়েছে।”
সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে ইতিকাফ পছন্দ করবে,সে যেন এতেকাফ করে। তারপর সাহাবায়ে কেরাম নবীজি সাঃ এর সঙ্গে এতেকাফে শরীর হন। (মুসলিম শরীফ।)
শবে কদরের ফজিলত
পবিত্র মহাগ্রন্থ কোরআন মাজীদ নাযিল হওয়ার কারণে শবে কদরের ফজিলত অনেক। কারণ কদরের রাতেই এই মহাগ্রন্থ আল কুরআন নাযিল হয়েছে।তাই রমজানের রাতগুলোর মধ্যে কোরআন নাজিলের রাত লাইলাতুল কদর সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ একটি রাত।
আরও পড়ুনঃ
মহান আল্লাহ এ সম্পর্কে বলেন,” আমি একে নাযিল করেছি কদরের রাতে। তুমি কি জানো কদরের রাত কি?কদরের রাত হাজার মাসের চেয়েও উত্তম।”( সূরা কদর আয়াত ১-৩)
অর্থাৎ এ রাতের ইবাদত অন্য হাজার মাসের ইবাদতের চেয়ে উত্তম।তাবেয়ি মুজাহিদ রাদিয়াল্লাহু বলেন, এর ভাবার্থ হল,এ রাতের ইবাদত,দরুদ কিয়াম, তেলাওয়াত ও অন্যান্য আমল হাজার মাস ইবাদতের চেয়েও উত্তম। হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু বলেন, “ওফাতের আগ পর্যন্ত প্রত্যেক রমজানের শেষের ১০ দিন নবীজি সাঃ ইতিকাফ করতেন।”(বুখারী শরীফ ২৩২৬ ও মুসলিম শরীফ ১১৭২)
কিন্তু তিনি যে বছর ওফাত যান, সে বছর ২০ দিন এতেকাফ করেন। (বুখারী শরীফ)
শবে কদরের আলামত
শবে কদরের আলামতের মধ্যে কিছু দৃষ্টান্ত হচ্ছে এ রাত বেশি ঠান্ডা ও হয়না, বেশি গরম ও হয় না বরং তা হয় উজ্জ্বল।জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ্ রাজি বর্ণনা করেন, রাসূল সাঃ বলেছেন, “আমাকে লাইলাতুল কদর দেখানো হয়েছিল, তবে পরবর্তীতে তা ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। এ রাত হলো রমজানের শেষ ১০ দিনের রাত গুলোয়। এ রাত হলো মুক্ত ও উজ্জ্বল, যা ঠান্ডা ও না গরমও না।” (তিরমিজি।)
শবে কদর শেষে সকালের সূর্য আলোকরশ্মী ব্যতীত সাদা হয়ে উদিত হয়ে থাকে। উবায় ইবনে কা’ব রাজি কে যখন শবে কদরের আলামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়, তখন তিনি বলেন, “রাসূল সাল্লাল্লাহু ইসলাম যে নিদর্শনের কথা বলেছেন, তার দ্বারা আমরা লাইলাতুল কদর চিনতে পারি, অর্থাৎ ঐদিন সূর্যোদয় হয় রশ্মি বিহীন আকারে।”( বর্ননায় ইবনে খুজাইমাহ)
শবে কদরের আমল
শবে কদরের রাত পেলে এসব আমল ও দোয়ার দ্বারা সারারাত অতিবাহিত করা উচিত।
যেমন-
- বেশি বেশি কোরআন তেলাওয়াত করা। এবং সূরা কদর, সূরা ইয়াসিন, সূরা আর রহমান, সূরা ওয়াকিয়া, সুরা মুলক,সূরা কুরাইশ,সূরা দুখান, সূরা মুজাম্মিল ও চারকুল পাঠ করা।
- দরুদ শরীফ পাঠ করা।
- আল্লাহর জিকির করা।
- তওবা করা ও সাইয়েদুল ইস্তেগফার পাঠ করা।
- বিভিন্ন নফল নামাজ আদায় করা।
- মাগরিবের পর ছয় রাকাত আওয়াবীনের নামাজ পড়া।
- রাতে তারাবির নামাজ পড়া ।
- গভীর রাত্রে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া।
- সম্ভব হলে সালাতুত তাসবিহ পড়া।
- তাওবার নামাজ পড়া।
- সাধ্য অনুযায়ী দান সদকা করা।
- সবার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করা, ক্ষমা চাওয়া এবং কবর জিয়ারত করা।
তাই পরিশেষে শবে কদরের ফজিলতে মহান আল্লাহ তায়ালা সকল মুসলিম উম্মাহকে লাইলাতুল কদর পালন করার তৌফিক দান করুন।শবে কদরের রাতে ইবাদত বন্দেগী ও কুরআন তিলাওয়াতে কাটার এবং আমল করার তৌফিক দান করুন। আমিন।
0 মন্তব্যসমূহ