শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম আর সংহতির দিন মহান মে দিবস । ১৮৮৬ বর্ষের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকরা দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। ওই টাইম তাদের নির্দিষ্ট কোনো কর্মঘণ্টা ছিল না। নাম মাত্র মজুরিতে তারা মালিকদের ইচ্ছাধীন কাজ করতে বশীভূত হতেন। হে মার্কেট প্লেসে আহূত ধর্মঘটী শ্রমিক মিটিংয়ে পুলিশ গুলি চালিয়ে আন্দোলন স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল।
গুলিতে মারা গিয়েছিলেন ৬ শ্রমিক। এর প্রতিবাদে ৪ মে হাজার হাজার ওয়ার্রকার ফেটে পড়েছিলেন বিক্ষোভে। সেদিনও পুলিশের গুলিতে ৫ শ্রমিক মারা গিয়েছিলেন। আন্দোলন গড়ে তোলায় কয়েকজন শ্রমিককে মৃত্যুদণ্ড ও দেওয়া হয়েছিল। এভাবে প্রাণের বিনিময়ে শ্রমীকরা কায়েম করেছিল দৈনিক ৮ ঘণ্টা শ্রমের অধিকার। এরপর ১৮৮৯ বর্ষের ১৪ জুলাই প্যারিসে সংঘটিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে ১ মে ইন্টারন্যাশনাল কর্মচারী একতা ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
মে দিবস ২০২৩
মে দিবসের পথ ধরেই শ্রমিকদের নানা দখল অর্জিত হয়েছে। সেই সাথে নিজেদের ও তাদের শ্রমের পেয়েছে গুরুত্ব। বিশ্বজুড়ে ট্রেড ইউনিয়ন গুলো কর্মচারীদের ন্যায্য দাবি আদায়ের টার্গেটে কাজ করে যাচ্ছে। দেশে সম্প্রতি শ্রমিকদের সুযোগ-সুবিধার একসাথে কাজের পরিবেশও হয়ে গিয়েছে উন্নত। তবে অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলোর শ্রমিক শ্রেণির বিপর্যয় ঘোচেনি। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। কর্মচারী শ্রেণির দখল সাংবিধানিক ভাবে গ্রাহ্য হলেও তা মানা হচ্ছে না। প্রচুর বেসরকারি শিল্প-কারখানায় আইএলও নির্ধারিত শ্রমঘণ্টাও মানা হয় না। দেশের শ্রমীক শ্রেণি শুধুমাত্র উপযুক্ত মজুরি থেকে বঞ্চিত নয়, অনেক ক্ষেত্রে তাদের জীবন মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণও বটে। অগ্নিতে পুড়ে ও আলয় ধসে প্রায়ই মরতে হয় তাদের। মে দিবসে শ্রমিক শ্রেণির মানবেতর জীবনের অবসান ঘটানোর প্রতিশ্রুতি দিতে হবে আমাদের সবাইকে। সর্বাপেক্ষা যা জরুরী তা হলো, শ্রমের নিশ্চয়তা দেওয়া। কর্মচারী শ্রেণি সামাজিক ভাবে মর্যাদা অর্জন করতে পারেনি এখনো। কমিউনিটির অন্য পেশার মানুষের মতো শ্রমিকদেরও ১টি মর্যাদা সম্পন্ন হিসাবে লক্ষ্য রাখা উচিত আমাদের।
আরও পড়ুনঃ ২৬ শে মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবস
মে দিবস কি এবং কেন পালিত হয়
১৮৮৬ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেট প্লেসে নিহত শহিদদের আত্মত্যাগকে মনে রেখে এই দিনটি পালিত হয়। সেদিন দৈনিক ৮ ঘণ্টার কাজের দাবিতে শ্রমিকরা হে বাজারে জমায়েত করেছিলেন। চারি দিক ঘিরে থাকা পুলিশের প্রতি কেউ একজন বোমা ছোঁড়ে। তার পরে পুলিশ শ্রমিকদের ওপর গুলি চালাতে আরম্ভ করে।
বিশ্বে প্রথম শ্রম আন্দোলন কোথায় হয়েছিল?
১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে আর্জেন্টিনায় ১ম শ্রমীক দিবস পালন করা হয়, একই সময়ে ইন্টারন্যাশনাল কর্মচারী আন্দোলন প্রথমবারের মতো উদ্যাপন করে।
মে দিবস কত সাল থেকে পালিত হয়
১৮৮৬ সাল হতে আমেরিকায় ইন্টারন্যাশনাল কর্মচারী দিবস পালন করা হয়। যদিও ইন্ডিয়ায় এই দিনটি পালন করা হচ্ছে ১৯২৩ সাল থেকে।
রক্তাক্ত এক ইতিহাসের সাক্ষী মহান মে দিবস
আজ মহান মে দিবস। এ দিনটি শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের দিন। ইন্টারন্যাশনাল কর্মচারী দিবস হিসেবেও অবগত পহেলা মে। বরাবরই বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সাহায্যে এ দিনটিকে উদযাপন করা হয়। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর প্রায় ৮০ টি দেশে পয়লা মে জাতীয় ছুটির দিন হিসেবে গন্য হয়। আরো অনেক দেশে এটা বেসরকারিভাবে পালিত হয়।
শ্রমিক-মালিক নির্বিশেষ, মুজিববর্ষে গড়বো দেশ’- এই প্রতিপাদ্যকে সম্মুখে রেখে দেশে পালিত হবে এবারের মে দিবস। রক্তাক্ত এক ইতিহাসের দর্শনকারী মে দিবস। কর্মচারীরা সেদিন রক্তের বিনিময়ে নিজেদের কর্তৃত্ব আদায়ে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। দীর্ঘদিনের অমানুষিক নির্যাতন আর কম পারিশ্রমিক পাওয়া শ্রমিকরা মালিকপক্ষের ওপর গর্জে উঠেছিলেন।
কর্মচারীদের দাবি ছিল, ‘৮ ঘণ্টা কাজ, ৮ ঘণ্টা বিশ্রাম আর ৮ ঘণ্টা নিজের জন্য’। তারা প্রতিদিন ১০-১২ ঘণ্টা অথবা তার চেয়েও বেশি সময় কাজ করত কর্তৃপক্ষের নির্দেশে। এই দীর্ঘ কর্মঘণ্টার প্রভাব পড়ে দৈনন্দিন জীবনে। তাই বিশ্বের নানা প্রান্তের ‘শ্রমি কসংগঠনগুলো ৮ ঘণ্টা কাজকে অনুকরণীয় কর্মঘণ্টা হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবি জানায়।
১৮৮৬ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরের কর্মচারী আন্দোলনই মহান মে দিবস বা আন্তর্জাতিক ‘শ্রমিক দিবস নামে পরিচিত। শ্রমজীবী মানুষকে আরও সাহস জোগায় এই দিনটি। সব ধরনের অন্যায় আর অমানবিকতার বিপক্ষে গর্জে ওঠার পথ দেখায়।
আরও পড়ুনঃ এস এস সি পরীক্ষার শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি
মে দিবসে যা ঘটেছিল
আমেরিকার শিকাগো শহর তখন শিল্পায়নের অন্যতম কেন্দ্র। কাজের খোঁজে শিকাগোতে মার্কিন, জার্মান এবং ইউরোপের শ্রমিকেরা কাজের খোঁজে আসতে শুরু করেন। মাত্র গড়ে দেড় ডলারের বিনিময়ে তারা দিন-রাত কলুর বলদের মতো শ্রম দিয়ে যাচ্ছিলেন। এর উপর আবার সপ্তাহে ৬ দিন কাজ করতে হবে। অনেকটা যন্ত্রমানবের মতো কাজ করার যন্ত্র হয়ে উঠেছিল শ্রমিকরা। কষ্ট হলেও তারা মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে পারতেন না। কারণ শ্রমিকরা তখনও সংঘবদ্ধ হয়ে ওঠেননি।অনেকেই বিভিন্ন সময়ে ৮ ঘণ্টাকে প্রমাণ কর্মঘণ্টা হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়ে মালিকের হাতে নিপীড়িত ও নির্যাতিত হয়েছেন। এর ফলে অন্য শ্রমিকদের মনেও ভয়ের সঞ্চার করা হয়েছে।
আমেরিকার শিকাগো, নিউ ইয়র্ক, উইসকনসিন এবং বিভিন্ন রাজ্যে গড়ে ওঠে সংঘবদ্ধ আন্দোলন। ১৮৮৪ বর্ষের অক্টোবরে আমেরিকার ‘ফেডারেশন অব অর্গানাইজড ট্রেডস এন্ড লেবার ইউনিয়নস’ এর এক বৈঠকে ৮ ঘণ্টা কাজের সময় প্রতিষ্ঠার ব্যপারে আলোচনা আরম্ভ হয়। তারপর আমেরিকার বিভিন্ন লেবার ইউনিয়নের সম্মতিক্রমে ১৮৮৬ বর্ষের মে মাসের ১ তারিখে সাধারণ ধর্মঘট ডাকা হয়। দাবি ছিল একটাই, দৈনিক ৮ ঘন্টার অধিক কাজ আর নয়।
ধর্মঘটের বিরুদ্ধে মালিকপক্ষ আন্দোলনকে মোকাবেলা করতে কর্মচারী ইউনিয়নের নেতাদের গ্রেফতার করে। মালিকপক্ষের চাপিয়ে দেওয়া ১৪-১৬ ঘণ্টা কাজের বেড়াজাল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে প্রাণপণ যুদ্ধ করে শ্রমিকরা। ১৯৮৬ বর্ষের মে মাসের ১-৩ তারিখ পর্যন্ত এই আন্দোলন চলমান ছিল। এরপর শিকাগোর বিক্ষোভরত কর্মচারীদের ওপর চড়াও হয় পুলিশরা। শিকাগোর ম্যাককরমিক হারভেস্টিং মেশিন কোম্পানির সামনে পুলিশ গুলি চালায় কর্মচারীদের উপর। শত শত ‘শ্রমিক আহত হয়, নিহত হয় দুই জন। এই হতাহতের কারণে শ্রমিকরা ও উত্তেজিত হয়ে ওঠে। এর পরবর্তী দিন হাজার হাজর কর্মচারীরা আন্দোলনের প্রস্তুতি নিয়ে শিকাগোর 'হেমার্কেট স্কয়ারে' সমাবেত হন।
আগের দিন পুলিশকে টার্গেট করে অজানা একজন বোমা ছুঁড়েছিলেন। এর পরপরই পুলিশ এবং আন্দোলন কারীদের মধ্যে শুরু হয় বাক্য বিনিময় এবং সংঘর্ষ। এই সংঘর্ষে সাতজন পুলিশ এবং চারজন কর্মচারী নিহত হয়। দাবি উশুল করার জন্য আসা শত শত নিরস্ত্র ‘শ্রমিক হতাহত হয়। পৃথিবীর ‘শ্রমিকরা সংগ্রামের ইতিহাসে রক্তাক্ষরে এটি লিখনি হয়ে থাকে ‘হে মার্কেট ম্যাসাকার’ নামে। কিন্তু পুলিশের ওপর সেদিন কে বা কারা বোমা নিক্ষেপ করেছিলেন তা আজও অমিমাংসিত।
এই রক্তাক্ত ঘটনার পর মার্কিন রাষ্ট্রশাসক বিভাগ শ্রমিক ইউনিয়ন গুলোর বিপক্ষে জটিল অবস্থান নেয়। নৈরাজ্যবাদী হিসেবে ৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়। ইন্টারন্যাশনাল গণমাধ্যমে গ্রেফতারের ব্যাপারটা বেশ সাড়া ফেলে। হে মার্কেট ম্যাসাকারে যুক্ত থাকার অভিযুক্ত হওয়া ৮ জনের মধ্যে একজনকে ১৫ বছর কারাদণ্ড আর ৭ জনের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
তখন বিধান বিচার অ্যারেঞ্জমেন্ট কর্মচারীদের নিমিত্ত দাবি ‘৮ ঘন্টা কর্মঘণ্টা’ এই দাবিকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে যায়। এরপর ১৮৮৯ সালের মে মাসের ১ তারিখকে ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস’ বলে ঘোষণা দেয় ‘ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর ওয়ার্কার্স এন্ড সোসালিস্টস’। হে মার্কেট ম্যাসাকারকে শ্রমিক আন্দোলনের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
যদিও আমেরিকার গভর্নমেন্ট এই ঘটনার কোনো স্বীকৃতি দেয়নি এবং শ্রমিকদের আট ঘণ্টা কাজের দাবিকে ও মর্যাদা দেয়নি। অতঃপর ১ম বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯১৬ সালে আমেরিকা ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিকে আইনি স্বীকৃতি দেই। ১৯১৭ সালে দ্বিতীয় নিকোলাসের পতনের ৪ দিন পর আমেরিকা রাষ্ট্রীয় ঘোষণার মাধ্যমে ‘দিনে ৮ কর্মঘণ্টা’র স্বীকৃতি দেয়।
১৯১৭ সালের পর থেকেই সোভিয়েত ক্ষমতাবলয়ে থাকা দেশগুলোতে মে মাসের ১ তারিখে ইন্টারন্যাশনাল কর্মচারী দিবস বেশ জাকজমকতার সাথে পালন করা শুরু হয়। সোভিয়েত পতনের পরে রাষ্ট্রীয়ভাবে পর্যাপ্ত দেশেই পালন হয় মে দিবস। কিন্তু এখনো বিশ্বের ৮০ টি দেশে এই দিন সরকারী ছুটি হিসেবে চিহ্নিত।
0 মন্তব্যসমূহ