২৬ শে মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবস

 



বাংলাদেশ প্রতিবছর ২৬ শে মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবস কে জাতীয় দিবস হিসেবে পালন করে থাকেন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ মধ্যরাতে শেখ মজিবুর রহমানকে আটক করে। ২৫ শে মার্চ রাত বারো টার পরে অর্থাৎ ২৬ শে মার্চের প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে গ্রেফতারের কিছুক্ষণ আগে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা পত্রে স্বাক্ষর করেছিলেন। যা তৎকালীন চট্টগ্রাম ইপিআর ট্রান্স মিটারে প্রচার করার জন্য পাঠানো হয়।

২৬ শে মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবস

চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে ২৬ শে মার্চ, বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের পক্ষে এম এ হান্নান অনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণের ঘোষণা পাঠ করেন। আবার  জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে ২৭ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন  দ্বিতীয় বারের মতো। 

    ১৯৭২ সালের ২২শে জানুয়ারি তারিখে প্রকাশিত একটি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এই দিনটি বাংলাদেশের একটি জাতীয় দিবস হিসেবে উদযাপন করা হয় এবং সরকারিভাবে এই দিনটিতে ছুটির ঘোষণা করা হয়।

    বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান বন্দি

    জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে বন্দি হওয়ার আগ মুহূর্তে বাংলাদেশকে স্বাধীন ঘোষণা করে ২৬ শে মার্চের প্রথম প্রহরে তার দেশবাসীর কাছে একটি কেবল বার্তা পাঠিয়েছিলেন। এবং স্বাধীনতার পত্রটি  ঘোষণা করা হয় ইপিআরের তার বার্তার মাধ্যমে।

    যা ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছিল। জানা গেছে, ২৫ শে মার্চ মধ্যরাতের পর তিনি এই ঘোষণা দেন যা তখনকার ইপিআর  ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে সারাদেশে প্রচারিত হয়েছিল ।

    পরবর্তীতে ২৬ ও ২৭ শে মার্চ স্থানীয় চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে শেখ মজিবের স্বাধীনতার ঘোষণাটি কয়েকজন পাঠ করে শোনান। 

    মেজর সিদ্দিক সালিক পাকিস্তানের তৎকালীন পূর্বাঞ্চলীয় সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজির জনসংযোগ কর্মকর্তা ছিলেন। মেজর শালিক তার “উইটনেস টু সারেন্ডার বইয়ে লিখেছেন”। যখন প্রথম গুলি চালানো হয় তখন পাকিস্তান রেডিও স্টেশন থেকে শেখ মজিবুর রহমানের কণ্ঠস্বর শোনা যায়। মনে হয় সেই কন্ঠের কথাগুলো আগে থেকে রেকর্ড করে রাখা ছিল। সেই বাণীতে পূর্ব পাকিস্তানকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হিসেবে ঘোষণা করেন।

    বইটিতে তিনি আরো লিখেছেন ঘোষণায় শেখ মজিব বলেছেন “এটি আমার শেষ বার্তা হতে পারে” এই মুহূর্তে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনগণকে নির্দেশ দিচ্ছি, তারা যেখানেই থাকুক না কেন, যে কোন উপায় অবলম্বন করে দখলদার সেনাবাহিনীর মোকাবিলা করতে হবে। শেষ পাকিস্তানি দখলদারকে বাংলাদেশের ভূখণ্ড থেকে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত লড়াই করতে বলেছেন। 

    বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান বন্দি

    লন্ডন ডেলি টেলিগ্রাফ এর দক্ষিণ এশিয়ার সংবাদদাতা ডেভিড লসাদ লিখেছেন। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার বিষয়ে, অত্যন্ত কাঁপুনি ওয়ারলেস বার্তায় রিপোর্ট করেছেন ঘোষণাটি সম্ভবত পূর্ব রেকর্ড করা ছিল। 

    সংবিধানে ও বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের সেই ঘোষণাটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত ঘোষণাটি একটি হ্যান্ডবিল আকারে বাংলা ও ইংরেজিতে মুদ্রিত করে চট্টগ্রামের বিতরণ করা হয়, আওয়ামী লীগের নেতা জহুর আহমেদ চৌধুরী। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা চট্টগ্রামের ইপিআর সদর দপ্তর থেকে দেশের অন্যান্য অঞ্চলে ওয়ারলেস মারফত পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলেন।

    বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন

    ঐদিন দুপুর দুইটা দশ মিনিটে এবং ২ঃ৩০ মিনিটে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান।

    এই কালুর ঘাট ব্যাথার কেন্দ্রটির জনসাধারণকে একত্রিত করতে এবং মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। যেদিন এম এ হান্নান,সুলতানুল আলম,মাহমুদ হাসান, বেলাল মোহাম্মদ,আব্দুল্লাহ আল ফারুক, আবুল কাশেম সন্দীপ, কবি আব্দুস সালাম, মাহমুদ হাসান বঙ্গবন্ধু শেখ  মজিবর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণ এবং তারবার্তার উপর ভিত্তি করে স্বাধীনতা ও স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে অনুষ্ঠান সম্প্রচার করেন। 

    রবীন্দ্রনাথ এর ত্রিবেদীর মতে ২৬ শে মার্চ সকাল ৯ টায় আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে প্রচার করে যে ঢাকা ও অন্যান্য এলাকায় যুদ্ধ শুরু হয়েছে।  

    বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ঢাকা সেনানিবাসের অভ্যন্তরে আদমজী কলেজ থেকে বন্দী করলে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ফ্লাগ স্টাফ হাউজে। সন্ধ্যায় অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়ার আগে তিনি সেখানে বন্দী হয়ে সারাদিন কাটান।

    সেদিন সন্ধ্যায় রেডিও পাকিস্থানে, রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান বাংলায় চলমান আন্দোলনকে “রাষ্ট্রদ্রোহিতা” বলে এবং আওয়ামী লীগকে “নিষিদ্ধ” করেন।

     সেই দিন রাত্রেই গণহত্যা শুরু হওয়ার পর, বাঙালিরা অবিলম্বে বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহ করতে শুরু করে। পিলখানা ইপিআর এবং রাজার বাগ পুলিশ লাইনে সশস্ত্র প্রতিরোধ পাকিস্তানের সৈন্যদের প্রচন্ড গোলাগুলিতে বেশিক্ষণ টিকতে পারেনি।

    এদিন চট্টগ্রাম নওগাঁ, জয়দেবপু্‌, বরিশাল সহ বেশ কয়েকটি জেলায় বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয। 

    ২৫ শে মার্চের কালো রাত্রি

    এদিকে ২৫ শে মার্চ কালো রাত্রে শুরু করা গন হত্যা পাকিস্তানি সেনারা ২৬শে মার্চ পর্যন্ত চালিয়ে যাই।

    সেই দিন ঢাকায় কারফিউ জারি করা হয়েছিল, এবং  ভবন, বস্তি এবং বাজার গুলিতে ভারি মেশিনগান এবং আর্টিলারি রাউন্ড দিয়ে গুলি চালানো হয়েছিল। শহরের অসংখ্য ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বাঙ্গালীদের উপর গুলি করে আগুন দেওয়া হয়। 

    মার্চ মাসের ২৫ তারিখ রাত থেকে ২৬ তারিখের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরস্ত্র শিক্ষক, কর্মচারী এবং ছাত্রদের  উপর ট্যাংক, স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, রকেট  লাঞ্চার, ভারি মর্টার,এবং হালকা মেশিন গান সহ বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল।

    এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল, সলিমুল্লাহ হল, জগন্নাথ হল, সূর্যসেন  হল, মহসিন হল,ফজলুল হক হল,রোকেয়া হল এবং শিক্ষক আবাসিক এলাকায় হামলার ঘটনা ঘটে। ৯ জন শিক্ষক তাদের মধ্যে ডক্টর জি সি দেব,ডক্টর মনিরুজ্জামান,অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য,জ্যোতির্ময়,গুহঠাকুরতা (যিনি আহত হয়ে পড়ে মারা যান) পাকিস্তানিদের হাতে সেই রাত্রে খুন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলে নিসংসদ দানব দূরত্ব চালানো হয়। ফলের অন্তত একটি কক্ষে ৬ ছাত্রীর নগ্ন দেহ পরে তাদের বাধা অবস্থায় পাওয়া যায়। 

    সেই গণহতাই বেশিরভাগ শহীদদের লাশ বিভিন্ন হল সংলগ্ন মাঠে মাঠে চাপা দিয়ে তার ওপর বুলডোজার ব্যবহার করা হয়েছিল। সকালে সেনারা ক্যাম্পাসের শ্রমিকদের দিয়ে মৃতদেহ গর্ত ফেলতে বাধ্য করা হয়েছিল এবং এক পর্যায়ে লাশের স্তুপের পাশেই তাদের দাঁড় করিয়ে ব্রাশয়ের করে খুন করা হয়। 

    পুরো বিশ্ববিদ্যালয় জুড়ে সেই রাতে কতজন মারা গিয়েছিল তা এখনো স্পষ্ট নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় ১৯৫ জনের নাম রয়েছে যাদের সনাক্ত করা হয়েছে, তাদের মধ্যে ৬৬ জন জগন্নাথ হলের। 

    সেদিন ভোরে মধুর ক্যান্টিনের প্রতিষ্ঠাতা মধুসূদনের স্ত্রী যোগমায়া, সদ্য বিবাহিত বড় ছেলে রঞ্জিত এবং পুত্রবধূ রিনা রানীকে বাড়ির ভিতরেই হত্যা করেন। অসুস্থ মধুসূদন দে লুকিয়ে গিয়ে জীবন বাঁচাতে সক্ষম হন কিন্তু এক ঘণ্টা পরে পাকিস্তানিরা আবার ফিরে এসে তাদের ধরে ফেলে এবং জগন্নাথ হলের মাঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী ও শিক্ষকদের সাথে ব্রাশফায়ারে তাদের সবাইকে হত্যা করে।

    পাকিস্তানি সেনারা এদিন ভোর রাতে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন কে গুলি করে হত্যা করে। লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন ছিলেন একজন অবসরপ্রাপ্ত পাকিস্তানি নৌবাহিনী কর্মকর্তা ও আগরতলা মামলার দুই নম্বর অভিযুক্ত। পরে মরদেহটি একটি জিপ এ করে নিয়ে যায়। মৃতদেহ আর পরে পাওয়া যায়নি।


    সূত্রঃ তোফায়েল আহমেদ,বিবিসি,ডয়েচ ভেলে,রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী ”৭১- এর ১০ মাস”। 


    একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

    0 মন্তব্যসমূহ